
এক দাদা তার নাতির সাথে গল্প করছিলেন গ্রামের পুকুর নিয়ে। অনেকদিন আগের কথা, গ্রামে মানুষ ছিল কম। মোল্লা বাড়িতে বড় এক পুকুর ছিল। পুকুর ভর্তি ছিল মাছ। একদিন রাতে কনুই জাল নিয়ে গেলেন মাছ চুরি করতে। জাল ছড়িয়ে মারতেই গোল আকারে প্রসারিত হয়ে দখল করে নিলো পুকুরের এক কোনার বড় একটা অংশ। টেনে তুলে আনতেই দেখা গেল রঙ বেরঙের মাছ। লাল কার্পিও, রূপালী রুই-কাতল, সবুজাভ কই, কালচে টাকি আরো কত কী। এক জালেই এত মাছ উঠেছে যে তিনি সেটা বহন করে বাসায় আনতে পারছিলেন না। অল্প কিছু মাছ নিয়ে বাকিগুলো নীরবে ছেড়ে এলেন পুকুরে। পুকুরেই থাকুক, পরে কোনো দিন আবার লাগলে ধরে নেওয়া যাবে, পুকুর থেকে শেষ তো আর হয়ে যাচ্ছে না।
উপরের দৃশ্যটি একটা সময় পর্যন্ত অনেক গ্রামেই স্বাভাবিক ছিল। এখন আর পুকুরে সেই মাছ নেই, কারো জালে অনেক মাছ পড়লে তারা আর সেগুলো থেকে কোনোটিকে পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আসে না। এমনকি পোনা মাছকেও ধরে নিয়ে আসে বাসায়। আজকে তিতাস নদীতে কিংবা কুরুলিয়া খালে যিনি জাল ফেলছেন তার মনে একটাই চিন্তা, আমি যদি কোনো মাছকে ছেড়ে দিই সেই মাছ তো আর আমি পাবো না। আমার মতো করে অন্য কেউ তো আর মাছ ছড়বে না, তো আমি কেন ছাড়বো?
তার মনে যে একটা চিন্তা- অন্য কেউ ছাড়বে না, তাই আমিও ছাড়বো না, একই চিন্তা অন্যান্য জেলেরও। সকলেই একটু বেশি পাওয়ার জন্য পোনা মাছটিকে সহকারে ধরছে। ফলে হচ্ছে কি, ঘুরেফিরে সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেউই কাউকে ছাড় দিচ্ছে না, তার মানে নিজেও কারো কাছ থেকে ছাড় পাচ্ছে না। অথচ সকলেই যদি মেনে নিতো আজকে পোনা মাছটিকে ছেড়ে দিলে সেটি আগামীকাল কারো জালে পূর্ণাঙ্গ মাছ হয়ে অন্যের জালে ধরা দেবে, আর অন্যের জালে ছাড়া পাওয়া পোনা মাছ কোনো একদিন আমার জালে বড় মাছ হয়ে ধরা দেবে- তাহলে সকল জেলেরই সুদিন থাকতো। অথচ প্রায় সময়ই দেখা যায় জেলেরা সারাদিন জাল মেরেও সন্তোষজনক পরিমাণে মাছ পান না।

জেলেরা ছোট পোনাটিকেও ধরছেন কিন্তু তারপরেও তা যথেষ্ট হচ্ছে না; Photograph by Sirajam Munir
তো এর সমাধান কী? সহজ সমাধান দেখা যাচ্ছে সকলেই সচেতন হয়ে যাওয়া। ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে সহজ বলে মনে হলেও বাস্তবে বেশ জটিল। কোনো এলাকায় জনসংখ্যা অল্প হলে নিজেদের মাঝে পরামর্শ করে একটা বোঝাপড়ায় আসা যায়। কিন্তু সেই এলাকায় মানুষের পরিমাণ বেশি হলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যায়। অনেকটা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের মতো। কোনো একটা সিস্টেমে যত বেশি উপাদান থাকবে তার জটিলতা তত বেশি হবে। সমাজকে যদি সিস্টেম হিসেবে ধরা হয় আর প্রত্যেক মানুষকে যদি উপাদান ধরা হয় তাহলে বলা যায় মানুষের পরিমাণ যত বেশি হবে সমাজে জটিলতার পরিমাণ তত বেশি হবে।
ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে সমস্যাও বেশি। বিশেষ করে ঢাকায় মানুষের ঘনত্ব অবিশ্বাস্য। তাই ঢাকাতে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই একটার পর একটা জটিলতা লেগে থাকে। কীভাবে? সামান্য কিছু উদাহরণ দেখুন।
বছরের বেশিরভাগ দিনেই পাবলিক বাসগুলোতে স্বাভাবিকভাবে চড়ার মতো অবস্থা থাকে না। ঢাকার সকল অঞ্চলেই এত মানুষ হয় যে প্রায় প্রতিটি বাসেই মানুষের চাপে পিষ্ট হবার মতো অবস্থা তৈরি হয়। ঝুলে থেকে, চেপে চেপে গন্তব্যে যাওয়া- এটা ঢাকায় নিত্যদিনের চিত্র। বেশিরভাগ সময়ই এত মানুষ যে কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে নামার জন্য আগের স্টেশন থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। মানুষ ঠেলে দরজা পর্যন্ত আসতেই লাগে দুই মিনিট। আর পিঠে ব্যাগ থাকলে সেটি নিয়ে নামা আর কেওক্রাডং চূড়া জয় করা যেন সমান কথা।

ঢাকায় প্রতিটা দিনই এভাবে ভ্রমণ করতে হয়; Sonalinews.com
অফিসে যাবার আগে আগে ব্যাংক থেকে কিছু টাকা বাসায় পাঠাবেন? পারবেন না। অফিস মিস করতেই হবে। যেই মাত্র আপনি ব্যাংকে ঢুকবেন তখন দেখবেন ৫০ জনের পেছনে পড়ে আছেন। ব্যাংক খোলার আগেই পৌঁছে গিয়ে আগে আগে সিরিয়াল নেবেন? তাতেও প্রশ্ন। গিয়ে দেখবেন ব্যাংকের গেটেই লাইন ধরে আছে জনতা। মূল সমস্যা কোথায়? অতিরিক্ত জনসংখ্যায়।
খুব জরুরী কাজে ট্রেনে টিকেট দরকার? পাবেন না। ৯০% ক্ষেত্রেই এটা সত্য। ভাগ্যক্রমে টিকেট সংগ্রহ করে ট্রেনে শান্তিতে যাবার কথা কল্পনা করবেন? পারবেন না। স্ট্যান্ডিং টিকিটে কিংবা বিনা টিকিটে এত এত মানুষ উঠবে যে মানুষের চাপে আপনার নাকে মুখে এসে পড়বে মানুষের পেট-ভুঁড়ি। অথচ কিছু করারও নেই। কারণ তাদেরও যেতে হবে। আপনি টিকিট কেটে ফেলেছেন বলে তারা কাটতে পারেনি। এত মানুষের জন্য সরকার হুট করেই ব্যবস্থা করে দিতে পারছে না আবার তারাও সরকারের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতে পারছে না। আবার এদিকে আপনিও অর্থ দিয়ে টিকেট কিনেছেন, সে হিসেবে আপনি একটি সুন্দর পরিবেশে ভ্রমণ করার অধিকার রাখেন। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে হচ্ছে না, অর্থ দিয়েও পাচ্ছেন না সেবা।

ট্রেনগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড়; Photograph by Sirajam Munir

ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাঁদে উঠতে হচ্ছে মানুষদের; Photograph by Sirajam Munir
চাপ সহ্য করতে না পেরে পাবলিক টয়লেটে ঢুকলেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঢুকে দেখবেন বমি হবার মতো অবস্থা। এই অবস্থা দেখে আপনার চাপই গায়েব হয়ে যাবে। এগুলো আর কিছু নয়, অতিরিক্ত মানুষের অতিরিক্ত চাপের কারণে হয়েছে। খুব লোডশেডিং হচ্ছে? ঘেমে নেয়ে একাকার? বিদ্যুতের অভাবে কাজ আটকে আছে? চালের মিলটা চলছে না? কম্পিউটারটা বন্ধ হয়ে আছে? এগুলো অধিক মানুষের অতিরিক্ত চাহিদার ফলে তৈরি।
চুলায় গ্যাসের চাপ নাই তেমন? মিটমিট করছে শুধু? রান্না হচ্ছে না? উপোষ? সব হচ্ছে অধিক জনসংখ্যার কারণে। স্টেশনে কিংবা পাবলিক স্পেসে ফ্রি ওয়াইফাই আছে। খুব আশা নিয়ে আপনার ডিভাইস কানেক্ট করালেন। কিন্তু কোনো স্পিড পাচ্ছেন না। এরকম কখনো হয়েছে? এগুলো অধিক জনসংখ্যার ফল। ৫০ এমবিপিএস স্পিডের বিপরীতে কানেক্ট হয়ে যদি থাকে দুই হাজার জন তাহলে স্পিড পাবেন কোথা থেকে?

বৃষ্টি হলে ঢাকার রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে যায় আর যানবাহনগুলো যেন নিশ্চল হয়ে যায়; Photograph by Sirajam Munir
কে যেন একবার বলেছিল ঢাকার তথা বাংলাদেশের আই ক্রান্তিকালে মার্ভেল কমিকসের থানোসকে খুব দরকার। থানোস তার এক আঙুলের তুড়িতে যেমন মার্ভেল ইউনিভার্সের অর্ধেক মানুষ কমিয়ে ফেলেছিলেন, তেমনই তিনি যদি বাংলাদেশে এসে তুড়ি দিতেন তাহলে কমে যেত অনেক দুঃখ দুর্দশা। যদি সম্ভব হয় দুইবার কিংবা তিনবার তুড়ি দিলেও সমস্যা নেই। অর্ধেক থেকে আরো অর্ধেক হয়ে যাবে জনসংখ্যা।
সত্যি কথা বলতে, জনসংখ্যা কমিয়ে ফেলা কোনো সমাধান নয়। আজকে জনসংখ্যা কমিয়ে ফেললে একসময় সে সংখ্যা আবারো বেড়ে উঠবে। জনসংখ্যার সমাধান করতে হবে জনসংখ্যাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। এমন কিছু প্রকল্প হাতে নিতে হবে এবং এমন কিছু প্রকল্প উদ্ভাবন করতে হবে যেগুলোর মাধ্যমে জনসংখ্যাকে পরিণত করা যাবে শক্তিতে। তার জন্য বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, পরিকল্পনাবিদদেরকে একত্রে কাজ করতে হবে। ভাবতে হবে সুদূরপ্রসারী ভাবনা, নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ।