
ইংরেজি ভ্যালি শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। এর দ্বারা পাহাড়ঘেরা বিস্তীর্ণ এলাকাকে বোঝানো হয়, যার বুক চিরে কখনো কখনো প্রবাহিত হয় নদী। বাংলায় একে বলা হয় উপত্যকা। আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগে মেক্সিকো উপত্যকায় ১৪২৮ সালে যাত্রা শুরু হয় অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের। টেনোচটিটলান, টেক্সকোকো এবং ত্লাকোপান নগর-রাজ্যগুলোর মাঝে মৈত্রীর মাধ্যমে জন্ম হয় এই সাম্রাজ্যের। প্রায় একশো বছর টিকে থাকার পর অবশেষে ১৫২১ সালে স্প্যানিশ দখলদার এবং তাদের মিত্রদের হাতে পতন ঘটে অ্যাজটেকদের।
সম্রাট উইৎজিলিউইৎলের পুত্র প্রথম ত্লাসেইলেল একবার ঘোষণা দেন, যুদ্ধের দেবতা উইৎজিলোপোখ্ৎলিকেই সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে সম্মান করতে হবে। এরপর থেকেই অ্যাজটেকরা যুদ্ধের দেবতার সেবায় নিয়োজিত হয়। বছর বছর হাজার হাজার মানুষকে উৎসর্গ করা হতো উইৎজিলোপোখ্ৎলিকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে! তাদের এই নরবলির চমক জাগানো নানা দিকই তুলে ধরা হবে আজকের লেখার মধ্য দিয়ে।
১
দেবতাদের তুষ্ট করতে নিয়মিতই নরবলি দেয়া হতো অ্যাজটেক সমাজে। আর এজন্য প্রয়োজনীয় মানুষের যোগান দিতে বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দীদেরকে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই যুদ্ধবন্দীদের দিয়েও চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই তারা খুঁজছিলো এমন একটি উপায়, যার মাধ্যমে নিয়মিতভাবেই নরবলির কাজটি চালিয়ে নেয়া যাবে।

Image Source: badassoftheweek.com
২
নরবলির কথা শুনতে আমাদের কাছে এখন যত বীভৎস বা অমানবিকই মনে হোক না কেন, অ্যাজটেকদের কাছে তৎকালে বিষয়টি মোটেও সেরকম ছিলো না। বরং তাদের কাছে এটা ছিলো বেশ সম্মানের বিষয়। সাহসীরা এ নরবলির জন্য স্বেচ্ছায় নাম লেখাতো। এর মাধ্যমে তাদের জীবন সার্থক হয়েছে বলেই মনে করতো তারা।

Image Source: about-history.com
৩
অ্যাজটেক ক্যালেন্ডারের একটি মাসের নাম টক্সকাট্ল। বছরের পঞ্চম এ মাসটির ব্যপ্তি আজকের দিনের হিসেবে আনুমানিক ৫ থেকে ২২ মে পর্যন্ত ছিলো। এই মাসে একটি উৎসব অনুষ্ঠিত হতো, যার জন্য দেহাবয়বের ভিত্তিতে একজন পুরুষকে বেছে নেয়া হতো। সেই মানুষটির দেহে অবশ্য কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকা লাগতো। যেমন- তার চামড়া হওয়া লাগতো মসৃণ, দৈহিকভাবে খুব একটা মোটা না এবং চুলগুলো লম্বা ও সোজা।
পরবর্তী এক বছর ধরে এই লোকটিকে দেবতাদের মতো খাতির করা হতো। তাকে পরানো হতো দেবতা টেজকাটলিপোকার ন্যায় পোশাকাদি। লোকটির পুরো গায়ে কালো রঙ মাখানো হতো, বুকে থাকতো ঝিনুকের ব্রেস্টপ্লেট, মাথায় শোভা পেতো ফুলের তৈরি মুকুট এবং সেই সাথে সারা গায়ে জড়ানো অলঙ্কার তো ছিলোই।
লোকটিকে দেয়া হতো চারজন স্ত্রী, যাদের সাথে বেশ চমৎকারভাবেই কাটতো তার সময়গুলো। তাকে বলা হতো শহরের ভেতর দিয়ে একটি বাঁশি বাজাতে বাজাতে সে যেন হেঁটে যায় আর ফুলগুলোর গন্ধ শুঁকতে থাকে। এই সময় জনসাধারণ তার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করতো।
এভাবে বেশ আরাম-আয়েশেই কেটে যেত লোকটির জীবনের বারোটি মাস, শেষ বারোটি মাস। এরপরই তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বড়সড় এক পিরামিডের চূড়ায়। যেতে যেতে লোকটি এতদিন ধরে ব্যবহার করা বাঁশিগুলো ভাঙতে থাকতো। আশেপাশে জড়ো হতো হাজার হাজার জনতা। পিরামিডের চূড়ায় নেবার পর তাকে পাথরের বেদিতে শুইয়ে দিতো একজন পুরোহিত। সেই পুরোহিতের হাতে সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠতো আগ্নেয় কাচ দিয়ে তৈরি ছুরি। সেই ছুরিটি তিনি লোকটির বুকে সজোরে চালিয়ে দিতেন, বুক চিরে বের করে আনতেন তখনও ধুক ধুক করতে থাকা হৃদপিণ্ডটিকে।

Image Source: sites.google.com
লোকটির মাথাটি কেটে আলাদা করে রেখে দেয়া হতো একটি তাকে, যেখানে তার মতো আগে যাদেরকে বলি দেয়া হয়েছিলো, তাদের খুলিগুলো শোভা পেতো। মাংস কেটে আলাদা করে রান্না করা হতো, যা দিয়ে উদরপূর্তি করতো সমাজের অভিজাত শ্রেণীর লোকজন।
তারপর?
তারপর আবারও আরেকজন সুদর্শন পুরুষকে বেছে নেয়া হতো, তাকে সাজানো হতো টেজকাটলিপোকার মতো করে এবং এভাবে চলতেই থাকতো।
৪
এতক্ষণ তো গেলো কেবল টক্সকাট্ল মাসে বলি দেয়ার গল্প। এছাড়া অন্যান্য সময়ও তো নরবলি দিতো অ্যাজটেকরা। দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত সেসব মানুষের মৃতদেহ বিভিন্ন শস্যকণার সাথে মিশিয়ে রান্না করা হতো। এরপর তা দিয়ে উদরপূর্তি করতেন পুরোহিতগণ। মাঝে মাঝে উপস্থিত সকলের জন্যই একটু একটু করে স্বজাতির মাংস দেয়া হতো খাবার উদ্দেশ্যে। হাড়গুলো দিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্র ইত্যাদি বানানো হতো।

Image Source: Mexicolore
৫
এই যে এত নরবলির কথা বলা হচ্ছে, এটা কিন্তু সবসময় একরকম হতো না। উৎসবের তাৎপর্যের সাথে সাথে পাল্টে যেতো বলি দেয়ার ধরন, এবং সেই সাথে পাল্টাতো বলির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যাও।

Image Source: history.com
৬
অ্যাজটেক সমাজে চামড়া ছাড়ানো নিয়েও বিচিত্র এক উৎসব ছিলো, যা উৎসর্গ করা হতো তাদের দেবতা জিপে টোটেকের নিমিত্তে।
এ উদ্দেশ্যে উৎসবের ৪০ দিন আগে একজনকে মনোনীত করা হতো, যাকে অ্যাজটেকরা সম্মান করতো দেবতার মতোই। তার পুরো দেহে লাল পালক ও স্বর্ণের অলঙ্কার শোভা পেত। এভাবে আরাম-আয়েশে ৪০ দিন কাটানোর পর উৎসবের দিন তাকে ছাড়াও আরো আটজনকে মন্দিরে নিয়ে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হতো। তাদের চামড়াগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা হতো যে, দূর থেকে দেখে মনে হতো গাছের ছাল ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোতে হলুদ রঙ মাখানো হতো, যেন দেখে স্বর্ণের মতো মনে হয়।

Image Source: mayaincaaztec.com
এই চামড়ার কিছু অংশ পুরোহিতদের দেয়া হতো, যেগুলোর উপর তারা বিভিন্ন সময় নৃত্যচর্চা করতো। কিছু অংশ দেয়া হতো তরুণদের, যারা চামড়ার কোট গায়ে জড়িয়ে পরবর্তী ২০ দিন ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়াতো।