
মধ্যযুগে সেন্ট নিকোলাস নামে এক সাধু গোপনে উপহার দেবার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার স্মরণে প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর হল্যাণ্ডে সেন্ট নিকোলাস ডে পালিত হতো। তাছাড়া শীতের আগেই শস্য ঘরে তুলে উৎসবের প্রচলন ইউরোপে ছিল হাজার বছর ধরেই। ডিসেম্বর ব্যাপী এই উৎসবের সময় নরওয়ে, জার্মানি, ডেনমার্ক এবং সুইডেনের মানুষজন তাদের প্যাগান দেবতার উদ্দেশ্যে পশু বলি দিত। এদিকে রোমানেরা তাদের সূর্যদেবতার পূজা করত। অবশেষে ষোড়শ শতাব্দীর দিকে ক্যাথলিক চার্চ এই উপাসকদের ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হলো। তবে যে উৎসব তাদের রক্তে মিশে আছে, তা থেকে বের করে আনা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই ইতিহাসের কিছু অদলবদল করে ২৫শে ডিসেম্বর খ্রিস্টানদের প্রধান উৎসব ঘোষণা করা হলো। আর সেন্ট নিকোলাসের আদলে জন্ম নিলো 'সান্তা ক্লজ' চরিত্রটির।
তবে এসবের পাশাপাশি অনেক ভয়জাগানিয়া দৈত্য-দানবের উপকথাও প্রচলিত ছিল যুগে যুগে। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বাচ্চাদের ঘুমপাড়ানি গল্পে এমন অনেক রাক্ষস-খোক্কসের খোঁজ পাওয়া যায়, যারা কি না শিকারে বের হয় ক্রিসমাসের এই উৎসবমুখর মৌসুমেই। তেমনিভাবে 'সেন্ট নিকোলাস ডে'র সাথে সম্পর্কিত অনেকগুলো চরিত্রগুলোর দেখাও পাওয়া যায়। চলুন আজ জেনে আসি এরকমই ভয়ঙ্কর কিছু দানবের কথা।
গ্রিলা
আইসল্যান্ডের শিশুদের কাছে বহুল পরিচিত এই দানবী। শিশুখাদক হিসেবে পরিচিত গ্রিলা থাকে দুর্গম পাহাড়ের গুহার ভেতরে। এই আইসল্যান্ডিক ট্রোলের আছে তেরো সন্তান, যাদেরকে বলা হয় ‘ইয়ুল ল্যাডস’। এই ইয়ুল ল্যাডসদের একেকজনের কাজ একেকরকম আর নামগুলোও অদ্ভুত- মিট হুকস, উইন্ডো পিপার ইত্যাদি। কেউ বাচ্চাদের খেলনা চুরি করে, আবার কেউ তাদের জানালা দিয়ে উঁকি মারতে গিয়ে কোনো অবাধ্য শিশুকে দেখতে পেলে এক দৌড়ে গিয়ে খবর দেয় মাকে। রাতের অন্ধকারে কঠিন সাঁড়াশির মতো শীতল হাত বাড়িয়ে সেসব দুষ্ট শিশুদের বস্তাবন্দী করে ধরে নিয়ে যায় গ্রিলা। পরে তাদেরকে হাঁড়িভর্তি গরম পানিতে চুবিয়ে সিদ্ধ করে উদরপূর্তি করে গ্রিলা আর ইয়ুল ল্যাডের দল।

গ্রিলা; Source: centralfloridapost.com
ইয়োলাক্যাট্টোরিয়ান
ক্রিসমাসের সময়ে অনেকেই হয়তো পোশাক উপহার পেতে পছন্দ করে না। তবে ক্রিসমাসের সময়ে দেখা দেয়া আইসল্যান্ডের আরেক ভয়ানক দানব ইয়োলাক্যাট্টোরিয়ানের কথা জানলে হয়তো কেউই এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি করত না। শীতের মাঝামাঝি সময়ে নিমেষেই ফুরিয়ে যাওয়া ছোট্ট দিনের পরে যখন দীর্ঘ রাত নেমে আসে, তখন ইয়োলাক্যাট্টোরিয়ান বা ইয়ুল ক্যাটদের বিচরণ শুরু হয়। অলসতার কারণে নিজেদের ঘরের কাজ শেষ না করার কারণে নতুন পোশাক উপহার পায়নি যেসব শিশু, তাদের সন্ধানে থাকে ইয়ুল ক্যাটেরা। ভালোমতো খাটাখাটনি করে কোনো পোশাক উপহার পেলেই কেবল ইয়ুল ক্যাটের হাত থেকে বাঁচা যায়।

ইয়ুল ক্যাট; Source: Wilderutopia
পিয়ের ফুয়িতা
পিয়ের ফুয়িতার উপকথার উৎস জানতে হলে যেতে হবে সেই দ্বাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সে। সেই সময়কার একজন সরাইখানা মালিক ছিল পিয়ের ফুয়িতা। কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকে যে সে কসাই ছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে তিন শিশুকে চুরি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সে। হত্যার চিহ্ন লুকানোর জন্য ফুয়িতা এবং তার স্ত্রী তাদের কেটে রান্না করে ফেলে। পরবর্তীতে সেন্ট নিকোলাস এই ব্যাপারে জানতে পারেন। তিনি ঐ হতভাগা তিন শিশুকে পুনরুজ্জীবন দান করেন।

সেন্ট নিকোলাসের সাথে ফাদার হুইপার; Source: frenchentree.com
এই পৈশাচিক কাজের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে সেন্ট নিকোলাসের সাথে ভ্রমণ করতে বাধ্য করা হয় শিকলবদ্ধ পিয়েরে ফুয়িতাকে। দীর্ঘ কালো রোব পরিহিত কৃশকায় চেহারার ফুয়িতা দুষ্টু শিশুদের পিঠে চাবুক মেরে শাসন করে। এমনকি অনেককে তুলে নিয়ে গিয়ে তার পিঠের খাঁচায় ভরে ফেলে, পরে রান্না করে ফেলার জন্য। ফরাসি ভাষায় পিয়ের ফুয়িতা শব্দের অর্থই হলো চাবুকমারা ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে ফুয়িতা এবং তার স্ত্রীকে ‘ফাদার ফ্লগ’ এবং ‘মাদার ফ্লগ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তারা চাবুক মেরে কিংবা বাচ্চাদের জিভ কেটে দিয়ে তাদের অবাধ্যতার শাস্তি দেয়। গায়ের রঙ কালো হওয়ায় ডাচেরা একে ব্ল্যাক পিটার নামেও ডেকে থাকে। তবে কথাটি কিছুটা বর্ণবাদঘেঁষা হওয়ায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই নামটি বাদ দিয়ে দেয়া হয়। মজার ব্যাপার, এই উপকথার একটি ইরানী সংস্করণও আছে।
ক্র্যাম্পাস
ইংরেজিতে 'Krampus' শব্দের অর্থ থাবা। বড়দিনের সময় আল্পস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত গ্রামগুলোতে ভয়ানক চেহারার বড় বড় থাবাওয়ালা এক দৈত্যকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবে সান্তা ক্লজের পাশাপাশি এই ক্র্যাম্পাসের সাজেও অনেককে অংশ নিতে দেখা যায়। ভেড়ার চামড়া, শিং আর বার্চ গাছের তৈরি চাবুক দিয়ে তারা কাল্পনিক ক্র্যাম্পাসের পোশাক বানিয়ে নেন। ক্র্যাম্পাসকে অনেকটা সান্তা ক্লজের বিপরীত হিসেবে ধরা হয়। সারা বছর যারা ভালো কাজ করেছে, তাদেরকে উপহার দেয়া যেমন সান্তা ক্লজের কাজ; তেমনি সারা বছর যারা বিভিন্ন অপকর্ম করেছে, তাদেরকে শাস্তি দেয়া হলো ক্র্যাম্পাসের কাজ।

ক্র্যাম্পাস; Source: Ranker.com
ফ্রাউ পার্চটা
পূর্ব ইউরোপের শিশুদের কাছে ঘুমপাড়ানি গল্পের একটি চরিত্র হিসেবে বহুল পরিচিত ফ্রাউ পার্চটা। অনেকে একে 'বার্চটা' বলেও ডেকে থাকে। প্রতি বছর ৬ জানুয়ারি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব ‘দ্য ফিস্ট অফ দ্য থ্রি কিংস’ এর দিনে আগমন ঘটে তার। এই দিবসকে জার্মানিতে 'বার্চটেনটাগ' নামে ডাকা হয়। সেখান থেকেই এই নামের উৎপত্তি। ঝাড়ুর পিঠে চড়ে আগমন ঘটে এই ডাইনির। বার্চটা কখনো ফিনফিনে পোশাক পরিহিত সুন্দরী তরুণীরূপে আবার কখনো রুক্ষ চেহারার বৃদ্ধারূপে দেখা দেয়। উপকথা অনুযায়ী, তার ডান পা তুলনামূলকভাবে বাঁ পায়ের থেকে আকারে বেশ বড় হয়ে থাকে, হয়তো বা দীর্ঘসময় সেলাই করার জন্য। তাছাড়া যখন তখন হাঁসের রূপ নেবার ক্ষমতাও আছে তার। 'মাদার গুজ' নামক রূপকথাটির পেছনে ফ্রাউ পার্চটাই মূল প্রভাব রেখেছে।

ফ্রাউ পার্চটা ; Source: Hornet.com
বেলসনিকেল
সেন্ট নিকোলাস ডের সাথে সম্পৃক্ত আরেক চরিত্র হলো বেলসনিকেল। একে পার্সনিকেল, বেল্টজনিকেল, ক্রিসক্রিঙ্কেলও বলা হয়। বেলসনিকেলের কাহিনীর উৎপত্তি জার্মানির রাইনল্যান্ড অঞ্চলে। তবে জার্মান ঔপনিবেশিকদের কল্যাণে উপকথাটি চলে যায় সুদূর উত্তর আমেরিকা অব্দি। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া, নিউ ইয়র্ক, ম্যারিল্যান্ডে একটি জনপ্রিয় উৎসবও অনুষ্ঠিত হয় একে ঘিরে। এই ভয়ানক চরিত্রটি সান্তা ক্লজের আরেকটি কাউন্টারপার্ট।

বেলসনিকেল; Source: centralfloridapost.com
নেকট রুপরেখট
নেকট রুপরেখট নামক দানবটির ভূমিকাও অনেকটা বেলসনিকেলের মতোই। এরও আগমন ঘটে সেন্ট নিকোলাস ডের সময়। একে অনেকে 'রুপার্ট দ্য সারভেন্ট' বলেও ডাকে। কেউ কেউ বলে থাকে, সে দ্বাদশ শতাব্দীর এক কৃষক ছিল। আবার কেউ কেউ বলে, সে বন্য এক শিশু ছিল, যাকে সেন্ট নিকোলাস পেলে-পুষে বড় করেছেন। জার্মান মিথোলজির খুবই প্রচলিত একটি চরিত্র এই দানব, অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন অংশেও এর পরিচিতি আছে। এর কাজ হলো, বাচ্চারা ঠিকমতো স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে কি না, সে ব্যাপারে তদারকি করা। বাচ্চারা প্রার্থনা করলে তাদেরকে আপেল, বাদাম আর জিঞ্জারব্রেড উপহার দেয় নেকট রুপরেখট। আর না করলে তাদেরকে লাঠি কিংবা ছাইভর্তি বোঝা দিয়ে আঘাত করে।

নেকট রুপরেখট; Source: thoughtco.com
হ্যান্স ট্র্যাপ
ফ্রান্সের অ্যালসাস এবং লরেন্স প্রদেশে বাচ্চাদের হ্যান্স ট্র্যাপের কথা বলে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। এই উপকথার উৎপত্তি পঞ্চদশ শতাব্দীতে। হ্যান্স ট্র্যাপ ছিল মহাধনী নিষ্ঠুর এক ব্যক্তি। তার লোভ ছিল অনেক, সেজন্যই সে একসময় শয়তানের পূজা করা শুরু করে। ক্যাথলিক চার্চ প্রশাসন এই ব্যাপারে জানতে পেরে তাকে একঘরে করে ফেলে। এলাকার যেসব লোকজন একসময় তাকে মান্যগণ্য করত, তারা চরম ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে তাকে। অবশেষে তার সকল সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হয়। কর্পদকহীন অবস্থায় হ্যান্স ট্র্যাপ পালিয়ে যায় বনে।

হ্যান্স ট্র্যাপ; Source: Ranker.com
ক্র্যাম্পাসের বিষয়ে আরো কিছু জানতে রোর বাংলার এই লেখাটি আপনাকে সাহায্য করবে,
ক্র্যাম্পাস: দুষ্টু শিশুদের শাস্তিদাতা সান্তা ক্লজ