
আলকেমিস্টদের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘায়ু অর্জন সম্ভব কি না সেটা নিয়ে গবেষণা করা, নিকোলাস ফ্লামেলও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি কি পেরেছিলেন সেটা নিয়ে সফল গবেষণা চালাতে? পেরেছিলেন সেই সুধা তৈরি করতে? এলিক্সির অফ লাইফ?
তবে একটা ব্যাপার তাকে সবসময় খেয়াল রাখতে হতো, তিনি যে কাজ করছিলেন, অর্থাৎ কাব্বালার সহায়তায় আলকেমি, সেটা দেশের আইনে নিষিদ্ধ ছিল। যেকোনো রকমের জাদুবিদ্যাসংক্রান্ত কিছুই নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ তখন। তাই তিনি খুবই সতর্ক থাকতেন। কেউ এলেও যেন কিছু খুঁজে না পায় সে ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছিলেন।

কাব্বালাহ; Source: kabbalah.com
গুজব অবশেষে রাজা ষষ্ঠ চার্লসের কানেও এসে পৌঁছে। তিনি স্টেট কাউন্সিলের সদস্য ক্রামইসিকে নির্দেশ দিলেন ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে। কিন্তু চতুর আর সাবধানী নিকোলাসের ব্যাপারে কিছুই তিনি খুঁজে পেলেন না। তদন্তকাজ ফ্লামেলের অনুকূলেই গেল।

রাজা ষষ্ঠ চার্লস; Source: britannica.com
স্ত্রী পেরেনেল মারা গেলেন আগে, ১৩৯৭ সালে। তখন নিকোলাসের বয়স হয়েছিলো ৮০; শেষ ক’টা দিন ফ্লামেল আলকেমির বই লিখেই কাটালেন; আর কবরস্থানে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে লিখে দিলেন, তাকে কোথায় কীভাবে কবর দিতে হবে। সেইন্ট ক্যাক্স লা বশেরির শেষ মাথায়। তার কবরের ফলক আর সেই ফলকে কী লিখা থাকবে সেটাও প্রস্তুত করে ফেললেন তিনি। সেই পাথরের ফলকে থাকবে অনেক অনেক চিহ্ন, আর একটি সূর্যের ছবি, একটি চাবির ছবি আর একটি বন্ধ বইয়ের ছবি। প্যারিসের Musee de Cluny-তে আজও সেটা দেখা যায়।

নিকোলাস ফ্লামেলের টুম্বস্টোন বা কবরফলক, সম্প্রতি জে কে রোলিং এটি টুইট করেন আসন্ন মুভির প্রচারণার স্বার্থে; Source: Hypable

হাঁটুগেড়ে ফ্লামেল; Source: Wikimedia Commons
অবশেষে, ২২ মার্চ ১৪১৮ তারিখে ফ্লামেল মারাই গেলেন। তবে তার মৃতদেহ বাইরের মানুষকে দেখানো হলো না।
কিন্তু, মজার ব্যাপার, তিনি মারা যাবার আগেই, তার আলকেমির সাধনার কথা কীভাবে যেন প্রচার হয়ে যায়। রটে যায়, তিনি সোনা বানিয়েছেন, তার কাছে অমরত্বের সুধা আছে, কিন্তু তিনি ব্যবহার করেন না। তার কাছে পরশমণি তৈরির ফর্মুলা আছে। সেই ফর্মুলার লোভে দূরদূরান্ত থেকে লোভী মানুষ জড়ো হতে লাগলো। কারণ, তারা শুনেছে সেই ‘বুড়ো ধনী আলকেমিস্ট’ মরতে বসেছেন। এমন ধারণাও রটে গেল যে, তার কবরের উপর আঁকা সেই চিহ্নগুলো সমাধান করতে পারলেই পাওয়া যাবে সেই ফর্মুলা। কে পারবে সমাধান করতে? সকল আলকেমিস্টের তীর্থস্থান হয়ে দাঁড়াল এই প্যারিস। নিকোলাসের করা সকল মূর্তি আর ফলক রাতের আঁধারে মানুষ ভেঙে নিয়ে যেতে লাগলো। পাছে ক্লু মিস হয়ে যায়!
যা-ই হোক, এভাবে দুটো শতক পার হয়ে গেল। চলুন প্রবেশ করি ষোড়শ শতকে।
একজন ‘সম্ভ্রান্ত’ লোক এসে প্রমাণ করলেন, তিনি একজন বিখ্যাত আলকেমিস্টের বন্ধু, যিনি মারা গেছেন মাত্র। মারা যাবার আগে তিনি নাকি উইল করে গেছেন তার সমস্ত টাকা দিয়ে যেন ফ্লামেলের পরিত্যক্ত বাড়ি মেরামত করা হয়। সেই কাজটাই তিনি করতে এসেছেন মৃত বন্ধুর স্মরণে। জ্যাক্স লা বশেলির বোর্ড তাঁর কথা মেনে নিল আর বাড়ি মেরামতের অনুমোদন দিল। সেই লোক বাড়িতে ঢুকে পড়লেন অনেক শ্রমিক নিয়ে। বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ান তিনি, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই খুঁজে পেলেন না। কিন্তু এক জায়গায় হায়ারোগ্লিফিকে কিছু আঁকা দেখলেন, আর কিছুই না। এই কি একজন আলকেমিস্টের বাড়ি? কোনো চিহ্নই নেই কিছুর! শেষপর্যন্ত তিনি চলে যান, শ্রমিকদের কোনো বেতন না দিয়েই। তখন বোর্ড বুঝতে পারে সে আসলে ভণ্ড ছিল।

ফ্লামেলের বাড়ির পিলারে পিলারে অজানা সব প্রতীক; Source: Atlas Obscura
মজার ব্যাপার, সেই পাউডার ব্যবহারের আগেই ‘হাতছাড়া’ হয়ে যায়। আর বাকি বাড়ি দেখে মনে হলো, কেউ যেন আগে থেকেই সুকৌশলে সব কোথাও সরিয়ে নিয়েছেন, যেন তিনি জানতেন, সবাই কী খুঁজতে আসবে।
সপ্তদশ শতক আসতে আসতে সেই বাড়ির চার দেয়াল ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই থাকলো না।
কিন্তু, সেই ইহুদী আব্রাহামের বইয়ের কী হলো? নিকোলাস তার গবেষণার জিনিস দিয়ে যান তার ভাগ্নে পেরিয়ারকে। পেরিয়ার এরপর আত্মগোপনে চলে যান আর এরপর তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে তিনি নিশ্চয়ই সেই পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করেছিলেন কাউকে না কাউকে। কারণ, আবারও, রাজা ত্রয়োদশ লুই-এর সময় কিছু পৃষ্ঠা খুঁজে পাওয়া যায়।

রাজা ত্রয়োদশ লুই; Source: Wikimedia Commons
শোনা যায়, 'দুবো' নামের এক লোক রাজার দরবারে এসে সবার উপস্থিতিতে একটা সীসার বলকে সোনা বানিয়ে দিয়ে সবাইকে তাক করে দেয়! সাথে সাথে তাকে কার্ডিনাল রিশেলিও ডেকে নেন। এবং তার কাছে সেই বইয়ের পৃষ্ঠা আর কিছু কিছু কাগজ পাওয়া যায়। তবে, সে বলে সে আসলে কিছুই বোঝেনি এ বইয়ের। সে কিছু লাল গুঁড়ো 'পেয়েছিল' যেটা দিয়ে এমন রূপান্তর করা যায়। পরে তদন্ত করে দেখা যায়, এ লোকের অতীতে অনেক অপরাধ আছে, তাই তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ভিঞ্চেনেসের কারাগারে তার যাবজ্জীবন দণ্ড হয়।

vকার্ডিনাল রিশেলিও; Source: Wikimedia Commons
কবরের ভিতরে কফিন ছিল একদম ফাঁকা!
কোনোকালেই নাকি এখানে কোনো দেহ ছিল না। নিকোলাস যদি সেদিনই মারা গিয়ে থাকেন, তবে তার কবর এখানে হয়নি। এটা ছিল নিকোলাসেরই একটি চতুর প্রদর্শনী।
নিকোলাসের অস্তিত্ব নিয়ে কিছু জানতে পারলো না মানুষ। কে সুকৌশলে তার সব জিনিসপত্র নিয়ে গেল বাড়ি থেকে? সেগুলো কোথায়ই বা রাখল? আর কেনই বা এমন করা হল? কোথা থেকে নিকোলাস এত টাকা পেলেন? আর কেন তিনি এমন কবর দেয়ার নাটক করালেন? তার উত্তরাধিকারী কে হলো? সেই বইয়ের বাকি অংশ কে বা কাদের তিনি দিয়েছিলেন?
জানা যায়, সেই বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা কার্ডিনাল রিশেলিও নিজের কাছে রাখেন, তিনি একটা গবেষণাগার বানান। কিন্তু তিনি কি পেরেছিলেন কিছু করতে? আপনি ভাবছেন, নিকোলাসের কথা এখানেই শেষ? কিন্তু এরপরও যে চমক রয়ে যায়, তা জানেন কি? আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সবার পরিচিত মহাবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন কেন পরশমণি নিয়ে বই লিখে গেলেন? কী লিখেছিলেন? নিউটনের কথা আপাতত শুরু করা যাক তবে।
লোককথা আর ইতিহাসের মিশেল আমাদের আরও কিছু জানায়। কিন্তু সব তো এক পর্বে লিখে ফেললে হয় না। চলবে পঞ্চম পর্বে!