
অ্যান্টার্কটিকা, যতদূর চোখ যায় ধু ধু বরফের রাজ্য। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা গিয়ে দাঁড়িয়েছে হিমাংকেরও নীচে নব্বই ডিগ্রি সেলসিয়াসে, কোথাও বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩২২ কিলোমিটার। সর্বত্রই যেন বসবাসের জন্য প্রতিকূল এক আবহ। তবে এত কিছু সত্ত্বেও মানুষের পদচারণা ঠিকই ছিল এখানে। তারই প্রমাণ দিতে যেন বরফের এই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে মানুষের অনেক দেহাবশেষ।
চিলির রহস্যময় হাড়গোড়
অ্যান্টার্কটিকার লিভিংস্টোন দ্বীপে ১৭৫ বছর আগের মানুষের মাথার খুলি আর ফিমারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অ্যান্টার্কটিকায় পাওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন দেহাবশেষ এটি। ১৯৮০ সালে লিভিংস্টোন দ্বীপের সৈকতে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় একুশ বছর বয়স্ক এক তরুণীর দেহাবশেষ এটি। তার বাসস্থান ছিল চিলির দক্ষিণাংশে।

চিলির বিজ্ঞানীদের গবেষণা ঘাঁটিতে নির্মিত চার্চ; Image source: Yadvinder Malhi
চিলির আদিবাসীদের নৌকায় করে দুঃসাহসিক সব অভিযানের কাহিনী সর্বত্রই প্রচলিত আছে। কিন্তু সেই ডিঙি নৌকায় করে প্রতিকূল সমুদ্রে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া আসলেই ভয়ানক কাজ। চিলির গবেষক দলের ভাষ্য অনুযায়ী, সেই নারী উত্তর গোলার্ধ থেকে আসা একদল শিকারী দলের সাথে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছিলেন। উইলিয়াম স্মিথ নামে এক গবেষকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সামুদ্রিক প্রাণী সিল শিকারে বের হওয়া একদল শিকারীর সাথে ১৮১৯ সালে যাত্রা শুরু করেছিলেন এই নারী। তবে এমন প্রতিকূল যাত্রায় নারীদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটি ঠিকভাবে মেলে না। অন্তত সে সময়কার প্রেক্ষিতে মেলে না।

সিল শিকারীদের সাথে চিলির আদিবাসীদের সম্পর্ক বেশ পুরোনো; Image source: Getty Images
স্কটের দুর্ভাগ্য
রবার্ট ফ্যালকন স্কটের নেতৃত্বে ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছায় ১৯১২ সালের ১৭ জানুয়ারি। তাদের সেখানে পৌঁছানোর তিন সপ্তাহ আগেই সেখানে পৌঁছায় নরওয়ের একদল অভিযাত্রী। ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল যখন এই ঘটনা জানতে পারে যে তাদের আগেই নরওয়ের অভিযাত্রীরা পৌঁছে গেছে তখন মানসিকভাবে তারা ভেঙে পড়ে।

রবার্ট ফ্যালকন স্কট তার দিনলিপি লিখছেন; Image source: Herbert Ponting
দক্ষিণ মেরুমুখী যাত্রা ছিল দারুণ বিপদসংকুল। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রতি পদক্ষেপ এগিয়ে যেতে হয় সেখানে। মেরুতে পৌঁছেও স্কটের দল সম্মুখীন হয় একের পর এক প্রতিকূলতার। একদিকে সীমিত রসদ অন্যদিকে ষাটজনের বিশাল দলকে পরিচালনা করা এবং দলের সকলকে চাঙ্গা রেখে অভিযান শেষ করে ইংল্যান্ড ফিরে যাওয়ার চিন্তায় স্কট বিভোর।

স্কটের দুর্ভাগা সঙ্গীরা; Image source: Getty Images
কার্ল রবার্ট ডিশ, অমীমাংসিত যার হারিয়ে যাওয়া
ন্যাশনাল ব্যুরো অফ স্ট্যান্ডার্ডস এর গবেষক কার্ল রবার্ট ডিশ। ১৯৬৫ সালের শীতে তার দায়িত্ব ছিলো পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার বিয়ার্ড স্টেশনে। কাজের প্রয়োজনে তাকে মূল স্টেশন কমপ্লেক্স থেকে প্রায়ই যেতে হতো বেতার কেন্দ্রে। চারদিকে বরফের রাজ্যে পথ চলতে গিয়ে যাতে রাস্তা না হারিয়ে ফেলেন সেজন্য একটি 'হ্যান্ড লাইন' নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছিলো। এই রাস্তা ধরে প্রায় পঁচিশবার তিনি মূল কমপ্লেক্স আর বেতার ভবনের মাঝে যাতায়াত করেছেন, কোনোরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই।
১৯৬৫ সালের ৮ মে সকালবেলা বেতার ভবন থেকে স্টেশনে ফিরছিলেন ডিশ। অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন আর তীব্র তুষারপাতের মধ্য দিয়ে সেই হ্যান্ড লাইন ধরে স্টেশনে পৌঁছে যাবার কথা ডিশের। কিন্তু তিনি নিখোঁজ হয়ে গেলেন। আশেপাশের এলাকায় খোঁজ করা হলো। ডিশ উধাও হয়ে গেছেন একদম। খারাপ আবহাওয়ার কারণে তাকে অনুসন্ধান অভিযান চালিয়ে যেতে একটু বেগ পেতে হলো। কিন্তু তারপরেও দফায় দফায় তার খোঁজ চালানো হলো। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছিলো না তাকে। একদমই শূন্যে মিলিয়ে গেলেন তিনি।

কার্ল রবার্ট ডিশ; Image source: southpolestation.com
হারিয়ে যাওয়া তিন তরুণ গবেষক
এমব্রোস মরগান, কেভিন অকলেক্টন এবং জন কোল নামে তিন তরুণ ব্রিটিশ গবেষক ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে বেরিয়েছিলেন ঘুরতে।স্বপ্নরাজ্য অ্যান্টার্কটিকাকে একটু ঘুরে দেখার জন্য ২২-২৩ বছর বয়সী এই যুবকরা বের হলেন। সাগর তখনো শান্ত, আকাশের মেরুজ্যোতি ছিল একটু বেশি উজ্জ্বল।
পিটারম্যান দ্বীপে পৌঁছানোর পর সেখানে থাকা একটি অস্থায়ী কুড়েতে আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল তাদের। সেই কুঁড়েঘরে খাদ্যসহ যাবতীয় দ্রব্য মজুত ছিল। কিন্তু দ্বীপে পৌঁছানোর পরই বাধলো বিপত্তি। ভীষণ ঝড়ে বরফ ভেঙে পড়লো, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো যোগাযোগ। তাদের চিন্তার খুব একটা কারণ ছিল না। কুঁড়েঘরে যা খাবার আর রসদপাতি ছিল তা দিয়ে অনায়াসেই মাসখানেক চলে যাওয়ার কথা।
অস্থায়ী এই কুঁড়েঘরে কোনো কাগজপত্র ছিল না, বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগের উপায় বলতে ছিল একটা বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, বাইরের অবস্থা তখনো খারাপ। বেতার যোগাযোগ সীমিত হয়ে আসছে ক্রমেই। ফুরিয়ে আসছে ব্যাটারি। এই বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তিন তরুণ গবেষক।
পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছিলো ক্রমান্বয়ে। কুঁড়েঘরে থাকা খাদ্যসামগ্রী পুরনো হয়ে যাচ্ছিলো। এগুলো খেয়ে তারা শিকার হলেন ডায়রিয়ার। বাধ্য হয়ে পেঙ্গুইন শিকার করে সেগুলো খেলেন। ১৫ আগস্ট তাদের রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। বাইরে তখনো প্রবল ঝড়ো হাওয়া বইছে, সমুদ্র উত্তাল।
তাদের আর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরেও তাদের মরদেহের খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয়, দ্বীপ থেকে মূল গবেষণাগারে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেছিলেন তারা। হয়তো পথ খুঁজতে গিয়ে পথেই চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছেন তারা।

অনেকের মরদেহই খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার অনেকেই চিরকালের মতো সমাহিত হয়ে আছেন অ্যান্টার্কটিকার বুকে; Image source: Getty Images
এগুলো ছাড়াও অ্যান্টার্কটিকার বুক সাক্ষী হয়ে আছে আরো অনেক দুর্ঘটনার। ধু ধু বরফের সমুদ্রে স্বজন, বন্ধু কিংবা সহকর্মীরা হারিয়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের দেহাবশেষ। তবে অ্যান্টার্কটিকায় প্রতিটি মৃত্যু দিয়ে যায় একেকটি শিক্ষা, প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় পরবর্তীতে যারা এখানে আসবেন তাদের প্রশিক্ষণে।