
স্বৈরাচারী বা অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোতে জনগণের ওপরে নজরদারি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় কাজ। বর্তমানে অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশেই নজরদারির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব সংস্থা এই কাজগুলো করে তাদেরকে গুপ্ত পুলিশ বা ওই ঘরানার নাম দেওয়া হয়। এই বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর সদস্যরা সরকারি সমর্থনের ফলে কখনো কখনো এত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে যে দেশের ইতিহাসেই এরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গুপ্ত পুলিশ বা সিক্রেট পুলিশ যদি লাগামছাড়া শক্তি পেয়ে বসে, তবে দেশের মানুষের কাছে তারা হয়ে ওঠে আতংকের অন্য নাম। বিলুপ্ত করে দেওয়া এমনই কয়েকটি কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থার কথা আজ বলবো।
স্তাসি (পূর্ব জার্মানি)
১৯৪৯ সালে সোভিয়েত সমর্থিত পূর্ব জার্মানী গঠিত হওয়ার মাস চারেকের মধ্যে স্তাসি গঠন করা হয়। স্তাসি শব্দটি জার্মান মিনিস্ট্রি ফর স্টেট সিকিউরিটি এর সংক্ষিপ্ত রূপ। শুরু দিকে এই সংস্থা খুব ছোট ছিল। মূলত পশ্চিমা গুপ্তচর আর নাৎসীদের ওপরে নজরদারি করাই এর কাজ ছিল। তবে ১৯৫৭ সালে এরিখ মিয়েল্কে এর প্রধান হয়ে আসার পর সব বদলে যায়। ১৯৮৯ সাল স্তাসিতে কর্মরত ছিল এক লক্ষ মানুষ। এর বাইরে অনিয়মিত এজেন্ট আর ইনফরমার ছিল প্রায় ২০ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ স্তাসির নজরদারির আওতায় ছিল। ইরাক সহ এশিয়া আর আফ্রিকার বহু দেশে স্তাসি এজেন্টরা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে।

source: pinterest

source: wikimedia commons
সাভাক (ইরান)
অর্গানাইজেশন অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ওরফে সাভাক ছিল ইরানের শাসক রেজা শাহ পাহ্লবী এর গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৫৭ সালে সিআইএ আর মোসাদের আদলে এটি গড়ে তোলা হয়। ইরানের সবথেকে ভয়ংকর সংগঠন ছিল এই সাভাক।
রেজ শাহ কম্যুনিস্ট আর ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে ভীষণ ভয় পেতেন। তার নির্দেশে সাভাক গোটা দেশ জুড়ে যথেচ্ছ ধড়পাকড় চালাতো। বিশেষ করে সাভাকের অত্যাচার আর জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি ছিল ভয়ংকর। বন্দীকে প্রয়োজনে অপহরণ করে খুন করে ফেলতেও সাভাক এজেন্টদের বাধতো না। বিদেশে পড়তে যাওয়া ইরানি ছাত্রদের ওপরেও নজরদারি চালাতো এই সংগঠন।
ঘুমাতে না দেওয়া, একলা আটকে রাখা, পায়ের পাতায় চাবুক মারা, নখ উপড়ে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক, সাপ দিয়ে ভয় দেখানো, নাকে এসিড ঢেলে দেওয়া, ধর্ষণ, বন্দীর গায়ে মূত্র বিসর্জন- সাভাকের অত্যাচারের ধরণ তালিকা করেও শেষ হবে না। বন্দীরা শেষমেষ বাধ্য হয়ে টিভিতে এসে স্বীকার করতেন নিজেদের দোষ। তারা ইরান সরকারের গুণগাণ করতেন। না করলেই আবার অত্যাচার। সাভাক তেহরানের কুখ্যাত এভরিন কারাগারসহ দেশজুড়ে অনেকগুলো নিজস্ব কারাগার পরিচালনা করতো। ১৯৭৯ সালে শাহের পতনের কিছুদিন আগে সাভাক বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। ‘পার্সেপোলিস’ নামক সিনেমাটিতে সাভাকের অত্যাচারকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
ওখরানা (রাশিয়া)
১৮৮১ সালে ওখরানা প্রতিষ্ঠা করে রুশ জার। মূলত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নিহিলিস্টদের দমন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধেও এরা প্রচুর কাজ করেছি। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে নির্বাসিত আর পলাতক কম্যুনিস্টদের অন্যতম আড্ডা প্যারিসেও ওখরানা সক্রিয় ছিল।

source: rarehistoricalphotos.com
১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরে উত্তেজিত জনতা ওখরানার কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়।
এনকেভিডি (সোভিয়েত ইউনিয়ন)
নারোদনি কমিসারিয়েট ভনুত্রেন্নিখ ডেল ওরফে এনকেভিডি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৭ সালে। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এটি কেবল সাধারণ পুলিশ সংস্থা ছিল। পরে, ১৯৩৪ সালে গুপ্ত পুলিশ ওগপু কে এর সাথে জুড়ে দিলে এনকেভিডি দারুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ও পরবর্তী সময়ে পূর্ব ইউরোপ আর সোভিয়েত ইউনিয়নে গজিয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোকে পিষে ফেলে এনকেভিডি। কাতিন গণহতার মতো অনেকগুলো গণহত্যা আর খুনের রক্ত লেগে আছে এই সংস্থার গায়ে। লক্ষাধিক মানুষ মরেছে এই সময়ে। এর বাইরে এনকেভিডির সবথেকে কুখ্যাত কাজ হল তিরিশের দশকে স্তালিনের নির্দেশে সোভিয়েত সমাজ আর কম্যুনিস্ট পার্টির লক্ষ লক্ষ মানুষকে বন্দী ও হত্যা করা, অত্যাচার, গুলাগে পাঠিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এনকেভিডির হাতে কেবল স্তালিনের সমালোচক হওয়ার অপরাধে বহু নিবেদিত কম্যুনিস্টকে প্রাণ খোয়াতে হয়েছে। ট্রটস্কিকেও হত্যা করে এক এনকেভিডি এজেন্ট।

source: pinterest
দিনা (চিলি)
দিরেক্তোরেত দে ইন্তেলিজন্সিয়া ন্যাশিওনাল ওরফে দিনা গঠন করা হয় ১৯৭৩ সালে, চিলিতে। জনপ্রিয় নেতা সালভাদর আয়েন্দেকে খুন করে তখন সদ্য ক্ষমতায় এসেছেন অগুস্তো পিনোশে। দেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ মানুষকে বশে আনবার জন্য দিনা গঠন করা হয়। শুরুতে এটি সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও ১৯৭৪ সালে একে পৃথক সংস্থা করা হয়

source: The Santiago Times
দিনা চিলিতে হাজার হাজার মানুষের গুম আর হত্যার জন্য দায়ী। মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা আর জীবিত বন্দীদের পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়া ছিল এর অত্যাচারের অন্যতম ধরণ। অপারেশন কন্ডোর আর অপারেশন কলম্বো নামের দুটি কুখ্যাত কম্যুনিস্ট বিরোধী কার্যক্রমে মার্কিন সিআইএর সাথে কাজ করেছে দিনা কর্মকর্তারা। হাজার হাজার বন্দীকে আতাকাম মরুভূমির বিরান অঞ্চলে আটকে রাখতো দিনা কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে, পিনোশের পতনের পর অনেক দিনা এজেন্টকে বিচারের আওতায় আনা হয়। পিনোশে অবশ্য বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগেই মারা যান।